খেলোয়াড়

এই পাতাটি শেয়ার করুন

           অনেকদিন পর কাকুকে দেখলামসমু-দা’র কাকুআমাদের পাড়ায় থাকত সমুদা, তার বুড়ো বাবা, বেশ বড় দাদা সোনাদা, অল্প বয়সী মা আর একটা ছোট্ট বোন পরে শুনেছিলাম সমুদা বাবার দ্বিতীয় পক্ষের, তাই সোনাদার সঙ্গে বয়সের অতটা তফাৎসেই সমুদার কাকুআর চেনাই যায় না আমি তো একবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়েই নিয়েছিহঠাৎ খেয়াল হলো চেনা চেনা লাগলো যেনআবার ভাল করে তাকাইগোঁফটা কামিয়ে ফেলেছে, চেহারাটাও ভাঙ্গা ভাঙ্গা, চুলের সে পাট নেই, সেই বাহারি ঢেউ খেলানো চুলের অর্ধেক উঠে গিয়ে ফাঁক ফাঁক হয়ে গেছে স্টেশনের বারবার ডাল ছাঁটা বাহারে গাছটার তলায় হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়েচোখের ভাবে বুঝতে পারলাম আমাকেও দেখেছে, কিন্তু ধরা দিতে চায় নাসেই আধা মফস্বলে তো খবর গুঞ্জরিত হতে সময় লাগে নি যাক 

          কোনদিন আউট দিত নাআমাদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতস্পষ্ট ক্যাচ, হাতে নিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত মনে এ ওর পিঠ চাপড়াই, কাকু ততোধিক নিশ্চিন্ত মনে, চোখে ও ভঙ্গিতে ব্যাট নিয়ে ফের দাঁড়িয়ে পড়েআমরা সমস্বরে চ্যাঁচাইআউট তো!! মানে!!

কাকু বলে আউট?? হুঁহকীসের আউট?? পায়ে লেগে গেছে।’

আমরা অসহায় চ্যাঁচাইঅসহায়কারণ সমুদাদেরই বাড়ির সামনে খোলা জায়গাতে খেলা হতোবল, ব্যাট, উইকেট অনেকটারই সাপ্লায়ার কাকুতাই দুচার বার এর ওর মুখের দিকে চেয়ে চুপ করে যাইদুতিন বার এমন হলে শেষে চোট্টামি করলে খেলা যায় নাচ্যাঁচাতে কাকু ব্যাট ছুঁড়ে ফেলে দুদ্দাড়িয়ে মাঠ ছেড়ে চলে যায় আসলে ব্যাট ছাড়া বোলিং, ফিল্ডিং এর মত গায়ে হাত পায়ের কাজ কাকুর এক্কেবারে পছন্দ ছিল নাবলের পিছনে বাকি পুরো মাঠ দৌড়ানোর খাটুনি কাকুর পোষাত না 

       কোন কিছুর পেছনে দৌড়ানোর খাটুনিই পোষায় নি আমরা যখন কাকুর সঙ্গে খেলতাম আন্দাজ তখনই তিনি পঁয়তিরিশআটতিরিশজীবিকা আমরা জানতাম নাতখন জানতে চাওয়ার বয়সও ছিল নাবেশ লম্বা শ্যামলা কাকুর শক্তপোক্ত চেহারা, মুখে একটা সরু করে ছাঁটা গোঁফ, মাথায় ঢেউ খেলানো চুলভালো জামা প্যান্ট পরে হাতে ব্যাগ নিয়ে বেরুলে চট করে উঁচুদরের লোক বলেই মনে হত মুখে একটা ঢাকনা ছিলখেলায় খুব চোট্টামি করেও কোনদিন মুখের ভাবে ধরা পড়তো না।  

         জীবনের মাঠে আমাদের ওপেনিং এর আগেই কাকু একটায়  ডিক্লেয়ার করে দিয়েছিলগান কাকু নাকি গান গাইতসুর ছিল, হারমোনিয়ামও ছিলফুল প্রজাপতি মার্কা আধুনিকের খবরটাই আমরা শুনেছিবেশ কয়েকটা গল্পও শুনেছি মফস্বলের সেরা তবলিয়ার মুখে।  

         মাইক জগতে তখন সবে নতুন ইকোপরিবেশ টরিবেশ নয়।  এক কথা দশবার করে শোনা যায়জগদ্ধাত্রী পুজোর ফাংশানদুজন তবলিয়াকে ধরে বেঁধে ঠিক করেছে কাকু দুজনেই বাজাবে একসাথেঘোষক আমাদের লালটুদাহাত-পায়ে চাউমিন বেরিয়ে পরেছেকোমরের দিকটা কেউ যেন ঘুঁষি মেরে পেছনে বেঁকিয়ে দিয়েছেটেরিকাটা চোস্তোকথাবাত্রায় একটু রস-রসিকতার ধার মাড়ায় তাই অ্যাংকরওদিকে দুজন তবলিয়া সন্ধ্যেবেলায় মোড়ের মাথায় হাজির হয়েছেসকাল থেকে ভেঁজে রাখা প্ল্যানে আজই তারা সিদ্ধিলাভ করবেকরেওছেমোড়ের দুদিকে দুটো রাস্তা উঁচুনিচুতাদের গোলমাল হয়ে যাচ্ছে কোনটা উঠে আসছে আর কোনটা সমান দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দুজনকে চোখে হাতের পাতা গোল করে দূরবীন দিয়ে দেখছি আবার ফিসফিস করে বলছে ‘ওই তুই এত লম্বা হয়ে গেলে কি করে? দেখিস বাবা ঘাড়ে পা দিস না যেন।’ একজন খিলখিল করে হাসছেভাগ্যিস মোড়ের সবাই ফাংশন দেখতে গেছে, দোকানগুলোও ঝাঁপ পড়ে গেছে তাই নইলে দুটো চেনা ছেলেকে এমন সিদ্ধিবাবা দেখলে লোকে যে কী করতো! খিলখিল হাসি কখন দোকানের সানে শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে এটা খেয়াল হয়নিঅন্যজন আঙুল গোল করে রাস্তা মাপছিলহঠাৎ মাইকের চিৎকার, লাল্টুদা ফুকারি উঠিলএবার সঙ্গীত পরিবেশন করতে আসছেনঅ্যাই ইকো টা বাড়িয়ে দে, বাড়িয়ে দে….বি মল মল মল মল মল সরকার আর আর আর….’ …। আমাদের কাকু সাদা পাঞ্জাবি পরে, ঘাড়ে পাউডার দিয়ে, খাতা বাগিয়ে স্টেজে উঠতে গিয়ে দেখে তবলিয়া নেই মাইকে আবার চিৎকার শোনা যায়সুবীরসুবীর!! তুমি যেখানেই থাকো এক্ষুনি স্টেজের কাছে চলে এসো।’  রাস্তামাপা সিদ্ধিবাবা গুটি গুটি এগোয় ফাংশনের দিকেকিন্তু বিশ হাত রাস্তা এত দূর!! পেরনোই যাচ্ছেনাঅন্ধকার অন্ধকার লাগছে যেনদূর ছাই

এই কোথায় পালাচ্ছকাকু চেঁচায় স্কুলের ঘন্টাপেটা পুটিরামদা হেডমাস্টারমশায়ের কথায় ফাইভের ছেলে যেমন ধরে সেই কায়দায় কাকুর দশ কেজির হাতটা তবলিয়া ধরে টেনে স্টেজে তোলেবি মল মল মল মল মল সরকারের গান নাকি এরপর ফাটাফাটি হয়েছিলতবলিয়া উড়িয়ে বাজিয়েছিল লোকের মুখে শোনাএসব ঘটার পর আমরা স্টানস নিয়েছি।  

         ক্রমে পেকে উঠে আমরা ছিটকে পড়লামক্রিকেট বন্ধ হয়ে গেল তার চেয়ে আরো দুর্দান্ত সব খেলায় মত্ত হয়ে পড়লামকাকুকে ভুলেই গেলামসমুদার বাবা মারা গেলেনকমার্সের গ্রাজুয়েশনটা কোনমতে শেষ করে সমুদা ফুলটাইম ছেলে পড়াতে শুরু করলোসোনাদা চাকরির ধান্দায় খুব ঘোরাঘুরি করতে লাগলশুনেছি সাইন্সের ভালো স্টুডেন্ট ছিল সোনাদাআমাদের আসা-যাওয়া কমে গেলবাইরে পড়তে চলে গেলাম 

         ক্রিকেট ছাড়ার বছর পাঁচেক পর শুনলাম কাকুর বিয়েশেষ বর্ষা সেদিন বিকেলেও বেশ বৃষ্টি হলোফ্যাশন দুরস্ত হাঁটু ছাড়ানো জংলা কাজের পাঞ্জাবিতে সেজে গেলাম কাকুকে দেখলামপাঞ্জাবি-পায়জামায় ভালোই লাগলোখুব ভিড়ঠেলে আর কাকিমা দেখতে মন উঠলো নাবাড়িতে কাকারা আলোচনা করছিল কাকু নাকি খুব দাঁও মেরেছেকোন বেসরকারি অফিসের সুপ্রিমো বলে পরিচয় দিয়ে বিয়ে করছেকয়েক লাখ টাকা নগদ আর সমস্ত ফার্নিচার, গয়না সব আমরা একটু অবাক চোখে ঘুমোলামধুর এসবকি হবে? 

        সাত দিন বাদেই পাড়ায় জোর খবরপাখি উড়ে গেছে মানে কাকিমা ভাগলবাকাকুও নিপাত্তাএকদিকে নয়, দুজনে দুদিকেকাকিমা বাপের বাড়ি আর কাকু নিরুদ্দেশ যেই বাড়ির সামনে দিয়ে যায় আড়ে আড়ে বাড়িটা দেখে বাড়ির লোকজনের কাছে সে চক্ষু শূলই বটেকাকিমা সব ধাপ্পা নাকি ধরে ফেলেছেতাই ডিভোর্সের মামলা ফাইল হয়েছেওদিকে কাকু বাড়ির লোকের সঙ্গে ষড় করে তলে তলে নাকি সরিয়ে ফেলেছে কাকিমার ফেলে যাওয়া জিনিসবেচে দিচ্ছে যা পাওয়া যায়বিয়ের বাজারের ধারটা তো মিটবেপাওনাদার তো বাড়িতে বসেই থাকেএকতলা বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় পাওনাদারদের দু-তিনটি সাইকেল সর্বদাই দেখা যায়আমরা খবর পেতাম ডিভোর্সের কেসে কাকুর নাকানিচোবানি অবস্থাপ্রথম কদিন শুনানিতে হাজির না হওয়ায় কাকিমার বাপের বাড়ি থেকে পণ নেওয়া, পণের জিনিস আত্মসাৎ করার মত অভিযোগে দ্বিতীয় মামলার জন্মএবার পুলিশ কাকুকে খুঁজে পেতে আদালতের কাঠগড়ায় জোর করে দাঁড় করিয়ে দিল।  

      কেস বেশি দিন চলেনিকাকু আদালতে নাস্তানাবুদ হয়ে পাড়ায় ঢোকার রাস্তা ভোলেআদালত রায় দেয় কন্যাপক্ষের সমস্ত পণের মূল্য হিসেব করে টাকা মিটিয়ে দিতে হবে ছয় মাসের মধ্যে, ডিভোর্সও গ্রাহ্য হয়।  

        আমরা দূর থেকে সমুদাকে দেখলেই এড়িয়ে যাই, না হয় অন্য রাস্তা ধরিপুরো বাড়িটাই যেন অচ্ছুত হয়ে ওঠেসমাজের ভদ্র মানুষেরা আর ভদ্রসমাজের মানুষেরা বাড়িটার দিকে সোজাসুজি তাকানো ছেড়ে দেয় মনে আছে সমুদার বাবাকে ক্রিকেট খেলার দিনগুলোতে দেখতাম সামনের লম্বা জায়গাটার সীমানায় কি যত্নে বেড়া বাঁধবেন! হাতে যা-কিছু পেতেন ছোট ভাঙ্গা কাঠের টুকরো , কঞ্চি, কাঁটাঝোপ সব দিয়ে আর প্লাস্টিকের দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধবেনআমরা বল আনতে গিয়ে ভেঙে ফেললে যথেষ্ট বকাবকি করতেনওদের ছাদে ওঠার সিঁড়ি ছিলনাএকটা সবুজ রঙের কাঠের মই লাগানো ছিল বারান্দার বাইরে কতবার ওই মই দিয়ে উঠে পাশের বাড়ির উঠোনে নজর করেছি নতুন কোণ থেকে দেখার লোভে 

     বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেলপুরো দশ  কাঠা জমির উপর একতলা বাড়ি, সামনে পেছনে প্রচুর জায়গাসমেত কিনে নিল তন্তুবায় সমিতির বেনামিতে পার্টিপাড়ার মোড়ের কাছে দারুণ পজিশনের বাড়িটা অসহায় মালিকদের মাথায় হাত বুলিয়ে ভীষণ কম দামে ঠকিয়ে নিয়ে পার্টি তন্তুবায়দের ভীষণ উপকার করলআর সমুদারা ফাঁড়ির সামনে এক চাঁচাছোলা মালিকের ভাঙাচোরা বাড়িতে ভাড়া গিয়ে উঠল 

         কিন্তু কাকুর কী হলো?? ওই যে দাঁড়িয়ে রয়েছে বারবার ডাল ছাঁটা বাহারি গাছটার তলায়ভাইপোদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেইপুরনো পাড়ায় দেখাবার মুখ নেইস্টেশনবস্তির ঘুপচি ভাড়া ঘর থেকে ট্রেন ধরতে এসে আয়েশি, গায়ক, চালাক, মুখবীর কাকু দাঁড়িয়ে আছেহাতদুটোকে বুকের কাছে ভাঁজ করা আমার সাথে চোখাচোখিও করল না

          আজও ধরা দেবেনাআউট হতে তার প্রবল আপত্তি 

লেখক পরিচিতি

তমোনাশ চট্টোপাধ্যায়

গুপ্তিপাড়ার সন্তান তমোনাশ বাংলা ভাষাসাহিত্য ও ইতিহাসে স্নাতকোত্তর। যুক্ত আছেন ভাষা চর্চার বিষয়ে। বাংলা, হিন্দি, উর্দু, সংস্কৃত ও উর্দুর পর তাঁর এখনকার চর্চা জার্মান ও মারাঠি ভাষা। ভাষাচর্চার মাধ্যমে দুনিয়াব্যাপী জীবনচর্চার মৌলিক একত্ব খুঁজে নিতে চান তমোনাশ।

তমোনাশের আরো লেখা পড়ুন তাঁর নিজস্ব ওয়েবসাইটে নিচের লিঙ্ক-এ ~

https://tamonash.artfolio.site

এই পাতাটি শেয়ার করুন

গুপ্তিপাড়া মিডিয়া নিবেদিত

আরো খবর পড়ুন

শ্রী শ্রী বৃন্দাবন চন্দ্র জীউ মন্দির ও মঠ

গুপ্তিপাড়ায় জনশ্রুতি আছে সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সত্যদেব সরস্বতী নামে এক তরুন সন্যাসী পর্যটক এসে পৌঁছন গুপ্তিপাড়ায় ভাগীরথীর তীরে। বেলা পড়ে এসেছে তখন। পথশ্রমে ক্লান্ত

পুরো পড়ুন >>

রথযাত্রা – ভাণ্ডারলুঠ

প্রভু শ্রী জগন্নাথ রথবিহারে বেরিয়ে তাঁর সখী পৌর্ণমাসীর ঘরে (চলতি কথায় মাসির বাড়ি) থেকে যান। লক্ষ্মীদেবী সর্ষেপোড়া দিয়ে প্রভুকে ফেরানোর চেষ্টা করেও বিফল হওয়ার পরে

পুরো পড়ুন >>

রথযাত্রা – লক্ষ্মীবিজয় বা সর্ষেপোড়া

জগন্নাথদেব প্রাকৃত লীলায় তার মাহাত্ম্য প্রকাশ করেন। তাই আমরা রথের গল্পে দেখতে পাই  শ্রীশ্রী জগন্নাথ রথবিহারে বেরিয়ে তাঁর সখী পৌর্ণমাসী-র ঘরে (প্রচলিত কথায় মাসির বাড়ি)

পুরো পড়ুন >>

গুপ্তিপাড়া রথযাত্রা

বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রাগুলির অন্যতম গুপ্তিপাড়ার জগন্নাথদেবের রথযাত্রা। বিশালাকায় কাঠের রথ, ২ কিলোমিটারের ওপর রথযাত্রা, লক্ষাধিক ভক্ত সমাগমে গুপ্তিপাড়ার রথ অন্যন্য। সোজারথ আর উল্টোরথের মধ্যে সর্ষে

পুরো পড়ুন >>

জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা

জ্যৈষ্ঠের পূর্ণিমা তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা। এইদিন জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার দারূমূর্তি আসন থেকে স্নানমঞ্চে নিয়ে আসা হয়। বহু ভক্ত সমাগমের মাঝে ১০৮ কলসি

পুরো পড়ুন >>

পাঠকের মন্তব্য

>