শ্রী শ্রী বৃন্দাবন চন্দ্র জীউ মন্দির ও মঠ

এই প্রতিবেদনটি শেয়ার করুন -
গুপ্তিপাড়ায় জনশ্রুতি আছে সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে সত্যদেব সরস্বতী নামে এক তরুন সন্যাসী পর্যটক এসে পৌঁছন গুপ্তিপাড়ায় ভাগীরথীর তীরে। বেলা পড়ে এসেছে তখন। পথশ্রমে ক্লান্ত সত্যদেব ভাগীরথীর ধারে পথের পাশেই একখান ইঁট মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়লেন। কয়েকজন গৃহবধু সে পথে কলসী নিয়ে জল আনতে যাচ্ছিলেন। সন্যাসীকে দেখে একজন কৌতুক করে তার সঙ্গিনীদের বললেন – “সন্যাসী ঠাকুর ঘরদোর সংসার ছেড়েছেন, কিন্তু বালিশের সুখটুকু ছাড়তে পারেননি।” তাঁরা এই নিয়ে হাসাহাসি করতে করতে চলে গেলেন। সত্যদেব অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে ইঁটখানা দূরে ফেলে দিলেন। জল নিয়ে ফিরবার পথে সেই দেখে মহিলাদের একজন আবার হেসে বলে উঠলেন – “দেখেছিস ভাই, সন্যাসী ঠাকুরের আবার রাগটুকুও আছে। ইঁটখানা সরিয়ে দিয়েছেন।” তাঁদের বাকপটুতায় মুগ্ধ সত্যানন্দ গুপ্তিপাড়াতেই তার সাধনস্থল স্থির করলেন। আদি গঙ্গার পাড়ে কিছু জঙ্গল পরিস্কার করে আশ্রম তৈরি করলেন। সে সময় আনুমানিক ১৬৪৬ খ্রীষ্টাব্দ। তার বছরদুয়েক পরে সত্যদেব সরস্বতী স্বপ্নাদেশ পেয়ে শান্তিপুরের এক ভক্তগৃহস্থের বাড়ি থেকে শ্রী বৃন্দাবনচন্দ্রকে এনে গুপ্তিপাড়ায় প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে শ্রী বৃন্দাবনচন্দ্র বিরাজ করেন স্বভাব সৌন্দর্যে সেই স্থানটিকে বৃন্দাবন বলে মনে হয়। এজন্য গুপ্তিপাড়া গুপ্তবৃন্দাবন নামে পরিচিত।

শ্রী বৃন্দাবনচন্দ্র জিউ মঠে মন্দিরের সংখ্যা মোট চারটি। শ্রী বৃন্দাবনচন্দ্র, শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র, শ্রী রামচন্দ্র ও শ্রী চৈতন্যদেব মন্দির। বাংলার নিজস্ব স্থাপত্যশৈলী, মৃৎশৈলী এবং অঙ্কনশৈলীর ঐতিহ্য মন্দিরের সর্বত্র উজ্জ্বল হয়ে আছে।

চারটি মন্দিরের মধ্যে শ্রী চৈতন্যদেবের মন্দিরটিই প্রথম নির্মিত হয়। আনুমানিক ১৭০০ খ্রীষ্টাব্দে। শ্রী বৃন্দাবনচন্দ্র প্রথমে এই মন্দিরেই অধিষ্ঠিত হন। এই মন্দিরটি জোড়বাংলা রীতিতে নির্মিত। বাংলার বিভিন্ন স্থাপত্যরীতির মধ্যে জোড়বাংলা বিরলতম। বর্তমানে এটিতে গৌর-নিতাই-এর মূর্তি আছে। মন্দিরের টেরাকোটার কাজ প্রায় কিছুই আজ আর অবশিষ্ট নেই।

এরপর প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রীরামচন্দ্র মন্দির। আনুমানিক ১৭৪০ খ্রীষ্টাব্দে। এই মন্দির বাংলার একরত্ন রীতিতে তৈরি। মন্দিরটি মঠের একমাত্র টেরাকোটার ভাস্কর্যযুক্ত মন্দির। রামায়ণ কাহিনীর অনেক চিত্র মন্দিরটির গায়ে উৎকীর্ণ আছে। এছাড়াও রাধাকৃষ্ণলীলা, দুর্গা ইত্যাদি দেবদবীর সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা, নৌকাযাত্রা, নৃত্যগীত ইত্যাদি সামাজিক চিত্রও আছে। মন্দিরের শ্রীরামচন্দ্র, সীতা, লক্ষণ ও বদ্ধাঞ্জলি হনুমানের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত।

মুর্শিদাবাদের নবাব আলীবর্দি খাঁ-র রাজত্বে গুপ্তিপাড়ার জমিদারি পান বৃন্দাবনচন্দ্র। রাজস্ব বাকী পড়ায় নবাবের দরবারে একবার বৃন্দাবনচন্দ্রের তলব পড়েছিল। তখন একটি নকল মূর্তি তৈরি করিয়ে সেটিকেই দরবারে উপস্থিত করা হয়। এই দ্বিতীয় মূর্তিটি রাখার জন্য কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দির তৈরী করা হয় আনুমানিক ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দে। এই মন্দির আটবাংলা রীতিতে নির্মিত এবং অলঙ্কারশূন্য।

মঠের মূল মন্দির শ্রী বৃন্দাবনচন্দ্র মন্দির। এই মন্দিরও আটবাংলা রীতিতে তৈরি। চারটি মন্দিরের মধ্যে এইটিই সর্বোচ্চ। মন্দির চূড়ায় পদ্ম ও কলস স্থাপিত। বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল ছাদে ও দেওয়ালে অঙ্কিত ফ্রেস্কো চিত্র। এই রীতি বাংলার মন্দিরে বিরলতম। আনুমানিক ১৮১০ খ্রীষ্টাব্দে এই মন্দির নির্মান হয়। পরবর্তী কালে ১৯১২-১৯১৫ সাল নাগাদ সরকারী অধিগ্রহণের সময় মন্দির সংস্কৃত হয়ে বর্তমান রূপ পায়। এই মন্দিরে শ্রী বৃন্দাবনচন্দ্র, শ্রী রাধিকা এবং গড়ুর মুর্তি রয়েছে। এছাড়াও এই মন্দিরেই রথের অধিষ্ঠাতা শ্রী জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার কাঠের মূর্তিও অধিষ্ঠিত থাকেন।

আনুমানিক ১৭৫০ খ্রীষ্টাব্দে শ্রী বৃন্দাবনচন্দ্রের মঠের তত্ত্বাবধায়ক পীতাম্বরানন্দ আশ্রম গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা প্রচলন করেন। আদিতে রথ ১৩ চূড়া বিশিষ্ট ছিলো । ১৮৭৩ সালে দণ্ডীস্বামী পৃথ্ব্যানন্দের সময়ে রথের তলায় চাপা পড়ে বেশ কিছু মানুষ নিহত হন। ফলস্বরূপ রথের আয়তন ছোট করা হয়। ১৩ চূড়া রথ এবার ৯ চূড়া বিশিষ্ট করা হয়। ৫১ ফুট উঁচু সেই রথের চূড়াও চলবার সময় আকাশ ছুঁয়ে যেত। কিন্তু কালের আঘাতে সেই রথও জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। ১৯৫৮ খ্রীষ্টাব্দে ৯ চূড়ার নতুন রথ তৈরীর সময় উচ্চতা আরও হ্রাস করা হয়। সেই রথই এখনো সংস্কৃত হয় ও যাত্রা করে। গুপ্তিপাড়ার রথেসজ্জার অন্যতম আকর্ষন বিশালাকায় কাঠের পুতুল। রথযাত্রার সময় রথের চূড়াগুলির পাশে এই পুতুল বাঁধা হয়। দেহরথের রূপকার্থে মানবমনের বিভিন্ন প্রবৃত্তির দ্যোতক হিসেবে পুতুলগুলো রথে সাজানো হয়।

গুপ্তিপাড়া শ্রীশ্রী বৃন্দাবনচন্দ্র জিউ মন্দিরের ভিতরের দেওয়ালে হাতে আঁকা ছবিগুলি ফ্রেস্কো। ১১৯১২-১৯১৫ সালে মন্দির সংস্কারের সময় এই ফ্রেস্কোগুলি আঁকা হয়। ভারতবর্ষে প্রায় ২৮০০ বছর পুরোনো ফ্রেস্কোর সন্ধান পাই অজন্তায়। কবি সত্যেন্দ্রনাথ অনুমান করেছিলেন তাতে বাংলার শিল্পীর অবদান ছিল। হয়ত তাঁদেরই কোনো প্রশিষ্যের হাতে এই মন্দিরে উঠে এসেছে ফ্রেস্কো ছবিগুলি। বাংলার মন্দিরে এই ধরন বিরলতম। ছবির বিষয় পুরাননির্ভর হলেও ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় প্রতিটি চিত্রকল্প বিশেষ অর্থবহ। ধরনে খাঁটি ভারতীয় এই ছবিগুলি মাধ্যম ও মননে বিশ্বের অন্যতম উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্ম। সময়ের নির্মমতায়, কিছু উদাসীনতায় ও কতক অসচেতন দর্শকের হাতের স্পর্শে ছবিগুলি ম্লান হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আজও এরা এক দেখায় আমাদের ভাবের গহীনে ডুবিয়ে দিতে পারে। এই মহার্ঘ সম্পদ সম্পর্কে আমরা আরো যত্নশীল হবো, এই আশা।
এই প্রতিবেদনটি শেয়ার করুন -

পাঠকের মন্তব্য

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    আরো প্রতিবেদন পড়ুন

    বাংলার প্রথম বারোয়ারি – গুপ্তিপাড়া শ্রী বিন্ধ্যবাসিনী পুজোর গল্প

    জনশ্রুতি অনুসারে, হুগলির গুপ্তিপাড়ায় স্থানীয় কিছু গ্রামবাসী এক জমিদার বাড়িতে দুর্গাপুজো দেখতে গিয়েছিলেন। কিন্তু জমিদারবাড়ির লোকেরা তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে এবং পুজোমণ্ডপে প্রবেশ করতে বাধা দেয় । এই ঘটনায় অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন যে, আর কখনও জমিদারবাড়ির পুজোয় যাবেন না, বরং নিজেরাই চাঁদা তুলে মায়ের আরাধনা করবেন। গ্রামের বারোজন যুবক এই উদ্যোগে […]

    কালীপুজো – বাংলার শক্তি উপাসনার সমন্বয়ধর্মী বিবর্তন

    আশ্বিনে দুর্গাপুজোর উৎসবের রেশ নিয়েই কার্তিকের অমাবস্যায় বাঙালী মেতে ওঠে শ্যামা মায়ের আরাধনায়। দুর্গাপুজোর মতই গৃহস্থ পরিবার থেকে শুরু করে মন্দির ও বারোয়ারি সর্বত্রই কালী পুজোর বিস্তার। দুর্গার মতোই কালীও বাংলার নিজের ঘরের মা হয়ে উঠেছেন আমাদের মানসপুজোয়। কালী প্রকৃতিগত ভাবে উগ্র, ভয়ঙ্করী এবং শ্মশানচারিণী। এই ভয়ানক রূপকল্পনা থেকে মমতাময়ী ঘরের মা কালী হয়ে ওঠার যাত্রা হিন্দুশাস্ত্র ও ইতিহাসের এক আকর্ষনীয় যাত্রা। শুধু ধর্মীয় পরিধি নয়, এই পরিবর্তনের পিছনে লুকিয়ে আছে বাংলার জীবনশৈলী, দর্শন ও সমাজের এক আশ্চর্য বিবর্তনের গল্প।

    দুর্গা পুজোর ইতিহাস ও বিবর্তন / পর্ব ২ / ধর্মীয় ও নৃতত্ববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন

    সম্পূর্ণ প্রতিবেদনের পাঠ শুনুন 00:00 1X Sorry, no results.Please try another keyword ৩/ ধর্মীয় শক্তিপুজোর দৃষ্টিকোন – বৈদিক ও পৌরাণিক মিশ্রন আমাদের জ্ঞানচর্চার একটা বড়ো মুশকিল হলো তথ্যের প্রাচুর্য কিন্তু বোধের অভাব। দুর্গা নিয়েও আমাদের ইতিহাস চর্চার মূল উদ্দেশ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখি কোন পুরাণে কী গল্প লেখা আছে তাই আলোচনা। অবশ্য অন্যরকম হওয়ার কথাও নয়। […]