00:00
1X
Sorry, no results.
Please try another keyword

দুর্গা পুজো বাঙালির বচ্ছরকার উৎসব। সারা বছর ধরে বাংলার গ্রাম শহর প্রতীক্ষা করে থাকে উমা বাপের বাড়ি আসবে বলে। আশ্বিনের প্রকৃতির সঙ্গে দুর্গাপুজোর আমেজ যেন এক হয়ে যায়। আশ্বিনের অমাবস্যায় মহালয়া। পিতৃতর্পণের মধ্যে দিয়ে পিতৃপক্ষের শেষ এবং পরবর্তী পনেরো দিন দেবীপক্ষ – লক্ষীপুজোয় যার শেষ। এই পনেরো দিনের মধ্যে ষষ্ঠী থেকে দশমী আমাদের দুর্গাপুজোর প্রচলিত রীতি। দেবী দুর্গার আবির্ভাবের বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী যেমন চমকপ্রদ, তেমনই আশ্বর্যজনক এই পুজোর ঐতিহাসিক ও সামাজিক বিবর্তন।
বাঙালীর দুর্গাপুজো শুরু হয় শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া দিয়ে। দেবী দুর্গার আদি রূপের ইতিহাস ওই মহালয়াতেই সবচেয়ে প্রামাণ্য ধরা আছে।
"এদিকে কালান্তরে দুর্ধর্ষ দৈত্যরাজ মহিষাসুরের পরাক্রমে দেবতারা স্বর্গের অধিকার হারালেন। অসুরপতির অত্যাচারে দেবলোক বিষাদব্যথায় পরিগ্রহণ হয়ে গেল।দেবগণ ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। ব্রহ্মার বরেই মহিষাসুর অপরাজেয়; তাঁর দ্বারা দৈত্যরাজের ক্ষয় সম্ভবপর নয় জেনে তাঁরই নির্দেশে অমরবৃন্দ কমলযোনি বিধাতাকে মুখপাত্র করে বৈকুণ্ঠে গিয়ে দেখলেন, হরিহর আলাপনে রত। ব্রহ্মা স্বমুখে নিবেদন করলেন মহিষাসুরের দুর্বিষহ অত্যাচারের কাহিনী। স্বর্গভ্রষ্ট দেবতাকুলের এই বার্তা শুনলেন তাঁরা। শান্ত যোগীবর মহাদেবের সুগৌর মুখমণ্ডল ক্রোধে রক্তজবার মত রাঙা বরণ ধারণ করলে আর শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী নারায়ণের আনন ভ্রুকূটিকুটিল হয়ে উঠল।তখন মহাশক্তির আহ্বানে গগনে গগনে নিনাদিত হল মহাশঙ্খ।বিশ্বযোনি বিষ্ণু রুদ্রের বদন থেকে তেজোরাশি বিচ্ছুরিত হল; ব্রহ্মা ও দেবগণের আনন থেকে তেজ নির্গত হল।এই পর্বতপ্রমাণ জ্যোতিপুঞ্জ প্রজ্জ্বলিত হুতাশনের ন্যায় দেদীপ্যমান কিরণে দিঙ্মণ্ডল পূর্ণ করে দিলে। ওই তেজরশ্মি একত্র হয়ে পরমা রূপবতী দিব্যশ্রী মূর্তি উৎপন্ন হল। তিনি জগন্মাতৃকা মহামায়া। এই আদ্যাদেবী ঋক্মন্ত্রে ঘোষণা করলেন আত্মপরিচয়—”
এরপর শুরু হয় গানের সুরে একটি সংস্কৃত মন্ত্রপাঠ – অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যহম্…। ঐটি ঋক্বেদের দেবীসূক্ত। ঋক্বেদের দশম মণ্ডলের একটি অংশ থেকে ৮ টি শ্লোক ‘মহালয়া’ অনুষ্ঠানে অন্তর্ভুক্ত হয়। শ্রী পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গীতায়োজনে আমরা সেটি শুনেছি। প্রথম তিনটি মন্ত্রের বাংলা দেখলেই বোঝা যায় ঋক্বেদের যুগে কীভাবে দেখা হতো দেবীশক্তি কে।
অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যহম্
আদিত্যৈরুত বিশ্বদেবৈঃ ।
অহং মিত্রাবরুণোভা বিভর্ম্যহম্
ইন্দ্রাগ্নী অহমশ্বিনোভা ।। ১
বাংলা অনুবাদ :- আমি একাদশ রুদ্র, অষ্ট বসু, দ্বাদশ আদিত্য এবং বিশ্ব দেবতারূপে বিচরণ করি। আমি মিত্র ও বরুণ উভয়কে ধারণ করি। আমি ইন্দ্র ও অগ্নি এবং অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে ধারণ করি।
অহং সোমমাহনসং বিভর্ম্যহং
ত্বষ্টারমুত পূষণং ভগম্।
অহং দধামি দ্রবিণং হবিষ্মতে
সুপ্রাব্যে যজমানায় সুন্বতে ।। ২
বাংলা অনুবাদ :- আমি দেবশত্রুহন্তা সোমদেবকে, ত্বষ্টা-নামক দেবতাকে এবং পূষা অভগ নামক সূর্যদ্বয়কে ধারণ করি। উত্তম হবিঃযুক্ত, উপযুক্ত হবিঃ দ্বারা দেবগণের তৃপ্তিসাধনকারী এবং বিধিপূর্বক সোমরসপ্রস্তুতকারী যজমানের জন্য যজ্ঞফলরূপ ধনাদি আমিই বিধান করি।
অহং রাষ্ট্রী সংগমনী বসূনাং
চিকিতুষী প্রথমা যজ্ঞিয়ানাম্ ।
তাং মা দেবা ব্যদধুঃ পুরুত্রা
ভূরিস্থাত্রাং ভূর্যাবেশয়ন্তীম্ ।। ৩
বাংলা অনুবাদ :- আমিই সমগ্র জগতের ঈশ্বরী, উপাসকগণের ধনপ্রদাত্রী, পরব্রহ্মকে আত্মারূপে সাক্ষাৎকারিণী। অতএব যজ্ঞার্হগণের মধ্যে আমিই সর্বশ্রেষ্ঠা। আমি প্রপঞ্চরূপে বহুভাবে অবস্থিতা ও সর্বভুতে জীবরূপে প্রবিষ্টা। আমাকেই সর্বদেশে সুরনরাদি যজমানগণ বিবিধভাবে আরাধনা করে।
উপরোক্ত তিনটি মন্ত্রেই পরিস্কার হয় এই দেবীশক্তি সমস্ত দেব দেবতা, সমস্ত যজ্ঞ ও যজ্ঞফল, সমস্ত প্রকৃতি ও জগতের মূল শক্তি। ঋক্বেদের লিখিত রূপের আনুমানিক ঐতিহাসিক কাল খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০০। সেই হিসেবে ধরা যায় পাঁচ হাজার বছর পেরিয়ে গেছে আমাদের ঐতিহ্যবাহী শক্তি উপাসনার। ঋক্বেদের যুগে অবশ্যই দুর্গাপুজোর আজকের রূপ ছিলো না। পাঁচ হাজার বছর ধরে এই উপাসনা পদ্ধতির বিবর্তন হয়েছে যুগে যুগে। রূপ খানিক খানিক পালটে পালটে গেছে দুর্গার।
খ্রিষ্টীয় প্রথম-দ্বিতীয় শতকে কণিষ্কের যুগে দেবী দুর্গার প্রত্নতাত্বিক মূর্তি পাওয়া গেছে। আমাদের বর্তমান দুর্গাপুজো বা চণ্ডী মূলতঃ মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারী। ঐতিহাসিকদের মতে মার্কণ্ডেয় পুরাণের রচনাকাল আনুমানিক ২৫০ খ্রীষ্টাব্দ। ভারতে তখন কুষান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত। গুপ্তবংশ, চোল ও চালুক্যবংশের রাজত্বে দুর্গাপুজো ছিলো এবং সেই সময়ের দুর্গার বিভিন্ন রূপ দেখা যায়। পৌরাণিক উপাখ্যানের সঙ্গে বিভিন্ন যুগের সাহিত্য ভাস্কর্য ইত্যাদি দুর্গাপুজোয় প্রভাব বিস্তার করেছে। আধুনিক যুগে এসে প্রভাব বিস্তার করেছে সামাজিক উৎসবের আবহ, বাণিজ্য ইত্যাদি।
বাঙালী তথা ভারতীয় জীবনযাত্রায় চিরকালই দুর্গা বা দেবীপুজোর প্রাধান্য স্বীকৃত। আর্য সংস্কৃতিতে কখনো তা ঊষা বা অদিতি, কখনো সরস্বতী। এর সঙ্গে যুগ যুগ ধরে অনার্য বিভিন্ন দেবীর মিশ্রন ঘটেছে। কালী তার মধ্যে অন্যতম। পৌরাণিক যুগে বৈদিক দেবীর আরো বিস্তার ঘটেছে। এবং দুর্গা, কালী, কৌশিকী, চামুণ্ডা ইত্যাদি রূপ আরো প্রাধান্য লাভ করেছে।
দুর্গাপুজোর উৎপত্তি, বিবর্তন ও প্রভাব বিচার করলে দুর্গাপুজোর মোটামুটি চারটি প্রধান দৃষ্টিকোন দেখা যেতে পারে। সময়ের সাথে সাথে এর প্রত্যেকটিই অন্যগুলির সাথে মিলেমিশে এক অনির্বচনীয় উৎসবের আকার ধারণ করেছে। এবং এই চারটি দৃষ্টিকোনের প্রত্যকটিই নিজস্ব ঐতিহ্যে ও ঐতিহাসিকতায় অনন্য।
১/ সামাজিক উৎসবের দৃষ্টিকোন - পারিবারিক ও বারোয়ারি পুজো
২/ শৈল্পিক এবং দার্শনিক দৃষ্টিকোন - দুর্গামূর্তির রূপকল্প
৩/ ধর্মীয় শক্তিপুজোর দৃষ্টিকোন - বৈদিক ও পৌরাণিক মিশ্রন
৪/ ঐতিহাসিক বিবর্তন ও নৃতত্ববিজ্ঞানের (Anthropological) দৃষ্টিকোন - দেবতা ও অসুর
এই সময়ে দুর্গাপুজো মূলতঃ সামাজিক উৎসব। এবং এই পুজোয় সবার সমান অধিকার। ঠিক যেমন লোকায়ত পুজোয় হয়ে থাকে। শরতকালে দুর্গাপুজোর এই উৎসবের রূপ বা অকালবোধনের ইতিহাস খুব বেশিদিনের নয়। পঞ্চদশ শতাব্দীর কবি কৃত্তিবাস রামায়ণ বাংলায় অনুবাদ করেন। এটি ‘শ্রীরাম পাঁচালি’ নামে প্রচলিত। কৃত্তিবাসী রামায়ণেই শরতকালে রামচন্দ্রের অকালবোধন করে দুর্গাপুজোর গল্প দেখা যায়। ফলে শরতকালে দুর্গাপুজোর আয়োজন পঞ্চদশ শতাব্দীর আশেপাশে বলে ধারণা করা যায়। তার আগে দুর্গাপুজো বসন্তকালে অনুষ্ঠিত হতো।
আনুমানিক ১৪৮০ নাগাদ তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ণের পুজোর ইতিহাস পাওয়া যায়। গুপ্তিপাড়ার দুর্গাবাড়ির মতে দুর্গাবাড়িতে পুজো শুরু হয় আনুমানিক ১৪৪০ নাগাদ। সে হিসেবে গুপ্তিপাড়ায় কেবল বারোয়ারি দুর্গাপুজো নয়, গুপ্তিপাড়ায় প্রথম পারিবারিক দুর্গাপুজোর সূচনা হয় যা পরবর্তীকালে বারোয়ারির মাধ্যমে উৎসবের আকার ধারণ করে। পারিবারিক এবং বারোয়ারি উভয়প্রকার দুর্গাপুজোর প্রচলনই প্রথম গুপ্তিপাড়ায় শুরু হয়।
ষোড়শ শতকের বাংলা পুরোপুরি শ্রীচৈতন্য এবং ভক্তি আন্দোলনে ভেসে যায়। দুর্গাপুজোয় ভক্তির মাহাত্ম্যের প্রবল সংযোজন হয় এই সময়ে। স্মার্ত রঘুনন্দন এই সময়েই দুর্গাপুজোর আধুনিক পদ্ধতির প্রচলন করেন। আজও মোটামুটি সেই নিয়মই অনুসরণ হয়ে আসছে।
১৬১০ সালে বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী বাড়ির পুজো শুরু হয়। বনেদি বাড়ির পুজো বলতে আজ আমরা যা বুঝি তা এই সময়েই শুরু। পারিবারিক পুজো প্রথম থেকেই ঠাকুরদালান এবং নাটমন্দির কেন্দ্রিক। সেখানে বাইরের লোকের প্রবেশ নেহাতই রবাহুত দর্শকের মত।
এরপর দুর্গাপুজোর প্রচার ও প্রসার বাড়তে থাকে। ১৭৯৭ সালে কৃষ্ণনগরের রাজা নবকৃষ্ণদেব বাহাদুর এবং কোলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোর প্রচলন শুরু হতে দুর্গাপুজো আধুনিক রূপ নেয়। কয়েকবছর পরেই ১৮০২ সালে শ্রীরামপুরের প্রেস থেকে উইলিয়াম কেরীর উদ্যোগে এই কৃত্তিবাসী রামায়ণ ছাপা হয়। সে সময়ের কোলকাতায় ইংরেজদের আধিপত্য ও বাঙালি বাবু সংস্কৃতি দুর্গাপুজোকে ক্ষমতা ও বিলাস প্রদর্শনের সমার্থক করে তোলেন। এই মনোভাবের পেছনে ইংরেজ প্রভুদের খুশি করে রাখার মানসিকতা প্রবলভাবে কাজ করেছিলো। ষোড়শ শতকে যে দুর্গাপুজো ভক্তির পরাকাষ্ঠা হয়ে উঠেছিল, সেই দুর্গাপুজোই কোলকাতার জমিদারদের হাতে পড়ে বিলাসবহুল উৎসব, নাচ-গানের জলসা ইত্যাদিতে রূপান্তরিত হয়েছিলো।
এইসময় গুপ্তিপাড়াতেও সেনবংশীয়রা জমিদারদের মতই আচরণ করতেন। গুপ্তিপাড়ার ধনাঢ্য সেন পরিবার জমিদার বাড়ি বলেই স্থানীয়ভাবে পরিচিত। যদিও সেই অর্থে সেনবংশীয়রা কোনদিনই জমিদার ছিলেন না। বাংলার বিখ্যাত সেন রাজবংশের সংগেও গুপ্তিপাড়ার সেনবংশীয়দের কোন যোগাযোগ নেই। অর্থবলে এরা নিজেদের জমিদার মনে করতেন এবং জমিদার মেজাজ প্রদর্শন করতেন। এই সেনবাড়ির দুর্গাপুজোতেই একবার স্থানীয় মানুষদের ঢুকতে দেওয়া হয় না। সময় আনুমানিক ১৭৯০ সাল। সে সময় পারিবারিক দুর্গাপুজো ছাড়া সামাজিকভাবে দুর্গাপুজো হত না। সেনবাড়ির দুর্গাদর্শনে ও পুজো দিতে বাধা পেয়ে গুপ্তিপাড়ার বারো জন বন্ধু মিলে দুর্গাপুজোর পরেই আয়োজন করেন বিন্ধবাসীনি পুজোর। বিন্ধবাসীনি দেবী দুর্গারই অন্য রূপ। গুপ্তিপাড়া থেকেই সেই প্রথম শুরু হয় বারোয়ারি সামাজিক পুজো। ধীরে ধীরে দুর্গাপুজোতেই এই বারোয়ারি পুজো চালু হয় যা এই সময়ে দাঁড়িয়ে দুর্গাপুজোর প্রধান পদ্ধতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিজাতদের হাতের মুঠো থেকে বের করে এনে দুর্গাপুজোকে সামাজিক উৎসবে রূপ দেওয়ার পেছনে গুপ্তিপাড়ার অবদান অনস্বীকার্য।
আমরা গুপ্তিপাড়ার বারোয়ারি পুজো শুরুকে বেশিরভাগ সময়েই কেবল ঐতিহাসিক তথ্য হিসেবে দেখি। কিন্তু একটু ভেবে দেখলে বোঝা যাবে সে সময় সেনবংশীয়দের প্রভাব এড়িয়ে সাধারণ কয়েকজন মানুষের দুর্গাপুজোর মত বড়ো পুজোর আয়োজন করা সোজা ছিলো না। এ ধরণের পুজোর জন্য প্রয়োজন ছিলো প্রচুর অর্থবল, প্রতিপত্তি, সামাজিক প্রাধান্য। এ সমস্তই অস্বীকার করে একবারে নতুন আঙ্গিকে পুজোর কথা ভাবার ক্ষমতা গুপ্তিপাড়া চিরকালীন সৃজনশীলতার পরিচয় বহন করে।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় জাতীয়তাবাদের প্রসারেও দেবীদুর্গার আরাধনার প্রচলন ছিলো। দেবী দুর্গাকেই বাংলার মণিষীরা ভারতীয় সংস্কৃতির পরিচায়ক ভেবেছেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ‘ভারতমাতা’ বা ঋষি অরবিন্দের ‘দুর্গাস্তোত্র’ জাতীয়তাবাদের প্রসারে বাঙালিদের উদবুদ্ধ করেছে।
হিন্দু ধর্মের যে কোন দেবদেবীর মূর্তি কল্পনাই আর্য দর্শন এবং পৌরাণিক উপাখ্যানের সমন্বয়। সাধারণ মানুষকে পৌরাণিক কাহিনী যতটা প্রভাবিত করে জটিল দর্শন বা রূপকের আড়ালে লুকিয়ে থাকা গভীর অর্থ ততোটা স্পর্শ করে না। এর জন্য বর্তমান সময়ের পল্লবগ্রাহী মনোভাব যেমন দায়ী, তেমনই পাশ্চাত্য আধুনিকতায় ভারতীয় ঐতিহ্য থেকে ক্রমাগতঃ সরে আসার প্রবণতাও বিশেষভাবে দায়ী। বর্তমান সময়ে আমরা দেবদেবীর মূর্তিকে কেবল পৌরাণিক গল্প বলেই ভাবতে অভ্যস্ত। যদিও পুরাণকে সাহিত্য বা কাব্যকল্পনা ভাবার মত আধুনিকতা প্রাচ্য পাশ্চাত্য কোন মানসিকতাতেই বিশেষ দেখতে পাওয়া যায় না। দেশীয় রক্ষণশীলরা দেবী দুর্গাকে শিবের পত্নী হিসেবেই ধারণা করে এসেছেন। আর নব্য আধুনিকরা একে কেবলই গল্প ভেবেছেন। এ দুই চূড়ান্ত মানসিকতা বাদ দিয়ে যদি শিল্পীর চোখ দিয়ে দেখি তাহলে দুর্গা মূর্তি এক অনন্য ভাস্কর্য হয়ে দেখা দেয়। রূপক বা উপমা শিল্পের প্রাণভোমরা। দুর্গা মূর্তিতেও প্রতিটা অংশ বিভিন্ন রূপক ও উপমায় তৈরি হয়েছে।
যেমন দুর্গার দশ হাত। প্রথম থেকেই দুর্গার দশভুজা মূর্তি পূজিত হয় নি। কুষাণ যুগে দ্বিভুজা দুর্গামূর্তি পাওয়া গেছে। বিভিন্ন শাস্ত্রে দুর্গার ষোড়শ, অষ্ট বা চতুর্ভুজা মূর্তির উল্লেখ রয়েছে। বর্তমানে দশভুজা রূপ প্রচলিত। দুর্গার পৌরাণিক কাহিনীর প্রধান উৎস হলো মার্কণ্ডেয় পুরাণ। দুর্গাপুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ‘শ্রীশ্রী চণ্ডী’ গ্রন্থটিও মার্কণ্ডেয় পুরাণের ৮১ থেকে ৯৩ অধ্যায়ের সংকলন। পুরাণ লেখা হয় বৈদিক যুগের শেষ দিকে। বেদ, উপনিষদ ইত্যাদি গ্রন্থের পরে। প্রধাণতঃ বৈদিক দর্শনকে সহজে বোঝানোর জন্যই পুরাণ লিখিত হয়। মার্কণ্ডেয় পুরাণ বৈদিক অদ্বৈতদর্শনের ভিত্তিতে রচিত। এই পুরাণেই চণ্ডী অংশের আগে যোগ, জ্ঞান ও ভক্তি দর্শন সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। চণ্ডী অংশের অবতারণা প্রকৃতি বা মায়ার স্বরূপ বোঝানোর জন্য। চণ্ডীর দর্শনে মায়া বা প্রকৃতিই সর্বশক্তিমান। এই শক্তিই বৈদিক ধারণায় হৈমবতী ঊমা। ফলে দুর্গার মূর্তি কল্পনায় বৈদান্তিক ব্রহ্মের ধারণা থাকাটাই স্বাভাবিক।

দুর্গামূর্তির দিকে দেখলে প্রথমেই দশভুজা রূপটিই চোখে পড়ে। হাত আমাদের নিয়ন্ত্রণের অঙ্গ। হাত দিইয়েই আমরা মূলতঃ প্রধান কাজগুলি করি। দেহের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে হাতই আমাদের বেশি কাজে লাগে। দুর্গার দশ হাত দশ ইন্দ্রিয়ের প্রতীক। হাতের মতোই দুর্গার দশ ইন্দ্রিয় তাঁর অধীন। অর্থাৎ তিনি দশ ইন্দ্রিয় জয় করেছেন। ভারতীয় দর্শনের প্রধান একটি ধারণা ইন্দ্রিয়জয়। দুর্গা ইন্দ্রিয়জয়ী যোগীনিশক্তি।
দুর্গার বাহন সিংহ। বাংলার বাঘ নয়। যদিও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে দুর্গার ব্যঘ্রবাহীনি রূপও দেখা যায়। কিন্তু আদি দুর্গামূর্তির বাহন সিংহ। তার মূল কারন আর্যরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারতে আসেন। মধ্যপ্রাচ্যে সিংহ আছে কিন্তু বাঘ দেখা যায় না। সিংহ পশুরাজ। দেবী সিংহকে বাহন করেছেন অর্থ তিনি পশুপ্রবৃত্তি জয় করেছেন। মানুষের মধ্যে ছয় রিপু হলো পাশবিক প্রবৃত্তি। তার মধ্যে কাম এবং ক্রোধ হল রিপুরাজ। সিংহ রিপুর প্রতীক। আরো প্রকৃষ্ট ভাবে কাম ও ক্রোধের প্রতীক। ছয় রিপুর মধ্যে প্রধান এই দুটি। তবে মজা হলো এই দুটি রিপু একেবারে বিনষ্ট হলেও চলে না। তাহলে সৃষ্টি ব্যহত হয়। কাম প্রজনন এবং ক্রোধ আত্মরক্ষার্থে বা ধর্মরক্ষার্থে প্রয়োজন। তাই সিংহ দেবীর বাহন।
আরেক পশু হলো মহিষ বা মহিষাসুর। এই পশুটিকে দেবী বধ করছেন। কাম আর ক্রোধ বাদে বাকী চারটি রিপু – লোভ, মদ (অহংকার), মোহ (আসক্তি), মাৎসর্য (হিংসা) মহিষের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে। এই চারটি রিপুর বধ করা প্রয়োজন। এই চার রিপু হলো আসুরিক। মহিষাসুর তার প্রতীক। দেবী এই চার রিপুর প্রতীক অসুরকে বধ করছেন।
তাহলে দুর্গা এমন এক দেবী যিনি দশেন্দ্রিয়জয়ী, কাম ও ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করেছেন, বাকী চার রিপু নির্মূল করছেন। বৈদিক দর্শনে এমন অবস্থায় পৌঁছলে তাকে যোগী বলা হয়। দেবী দুর্গা তাই যোগসিদ্ধির প্রতীক। এই যোগ আমাদের জীবনের যোগ।
দুর্গার চার পুত্রকন্যার কল্পনাও চমকপ্রদ। লক্ষ্মী ধনের দেবী। তার বাহন পেঁচা। পেঁচা হলো দিবান্ধ। অর্থ হলে মানুষ যা হয়। লক্ষ্মী পেঁচা বশ করেছেন তার ইঙ্গিত এই অর্থের স্বভাবই হলো অর্থবানকে দিবান্ধ করে দেওয়া। এ পেচকবৃত্তি জয় না করতে পারলে লক্ষ্মীলাভ হয় না।
দ্বিতীয় কন্যা সরস্বতী। অর্থের পর সরস্বতী হলেন জ্ঞানের দেবী। তাঁর বাহন হাঁস। হাঁস কাদা থেকে জল ফিল্টার করে খেতে জানে। এ বৃত্তি না অভ্যাস হলে জ্ঞান সম্ভব নয়। জ্ঞানী ব্যক্তিরা পরমহংস বলে কথিত হন সেই কারনেই। সরস্বতীর হাতে বীণা, বই। আমাদের দেশীয় শাস্ত্রে সমস্ত জ্ঞানের মূল উৎস হলো শব্দ। এবং শব্দ সঙ্গীতেই সবচেয়ে মধুর। সঙ্গীত তাই আমাদের সমস্ত সাধনার অন্যতম উপায়। জ্ঞানের দেবীর হাতে তাই সঙ্গীতের যন্ত্র।
দুর্গার পুত্রদের মধ্যে গণেশের রূপকল্পনাটি এক্কেবারে আলাদা। তাঁর মানুষের দেহে হাতির মাথা। সিদ্ধিদেব গণেশ। সিদ্ধির রূপক হিসেবে হাতির মাথা এল গণেশের মাথা হিসেবে। পুরাণকাররা কি জানতেন যে সমস্ত প্রাণীর মধ্যে হাতির মস্তিষ্কই সবচেয়ে বড়। মানুষের মস্তিষ্কের ওজন যেখানে এক দেড় কিলো, হাতির মস্তিষ্কের ওজন প্রায় পাঁচ-ছয় কিলো। উন্নত চিন্তার জন্য দায়ী যে সেরিব্রাল কর্টেক্স অঞ্চল, তাও হাতির মস্তিষ্কেই সবচেয়ে বেশি। ফলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো? সিদ্ধি মস্তিষ্কচর্চার ফসল। এবং সেব্যাপারে নিজের সীমাকে অতিক্রম করে অতিকায় চিন্তায় পৌঁছতে না পারলে সিদ্ধি সম্ভব নয়। আর ইঁদুর বাবাজি? তার স্বভাবের দিকে দেখুন। ক্ষতি করা ইঁদুরের জাতস্বভাব। সিদ্ধি হলে ক্ষমতা আসে। তখন অন্যের ক্ষতির ইচ্ছে জাগতে পারে। সে বৃত্তি বশ না হলে সিদ্ধি অসফল। গণেশ সে বৃত্তি জয় করেছেন। এটিই ইঁদুরকে বাহন কল্পনার মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছে।
অর্থ হলো, জ্ঞান হলো, সিদ্ধি হলো। এবার এদের সামলাতে হবে তো। রক্ষা করতে হবে। এইখানে এলো কার্তিকের রূপকল্পনা। কার্তিক শত্রুদমনে পারদর্শী। অনেকটা ময়ূরের মতই। সাপকে বিষসুদ্ধ হজম করে ফেলতে পারে ময়ুর। সে পাখি কিন্তু ওড়ে না। এই রূপকল্পে কি যোদ্ধার আভাস পাচ্ছেন? বা আরো গভীর করে বললে যোগী? যেমন ধরুন ময়ূরকূট শব্দটা। ময়ূরের পালকে যে গোলাকৃতি চিহ্ন দেখা যায় তাকে কূট বলে। কূট শব্দটার অর্থ জটিল বা ভ্রমাত্মক। বৈদান্তিক ধারণায় এই সমস্ত জগতকেই মিথ্যা ভ্রম বলে মনে করা হয়েছে। সিদ্ধযোগী একমাত্র এই মিথ্যার আবরণকে সরিয়ে সত্যকে জানতে পারেন। কার্তিকের বাহন ময়ূর এই যোগসিদ্ধির রূপক। কার্তিক কেবল বাইরের শত্রু দমন করেন না, তিনি যোগী বলেই আমাদের ভিতরের শত্রু মনের প্রবৃত্তিকেও তিনি দমন করতে পারেন।
আজকের যুগে আমদের নারীর স্বাধীনতা, অধিকার, নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হতে হয়। অথচ আমাদের চিরায়ত ধর্মভাবনা সমস্ত নারীকে শক্তি এবং সমস্ত শক্তিকে নারী হিসেবে কল্পনা করেছে, তাকে পুরুষের চেয়ে বেশী সম্মান ও শ্রদ্ধা করেছে চিরকাল। আদ্যাশক্তি মহামায়ার উপাসনা আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য। দুর্গার মূর্তিকল্পনাতেও সেই গভীর দিব্যভাবখানা কবির কল্পনার মতো বিভিন্ন রূপকে ফুটে ওঠে। শিল্পী ও দর্শনের দৃষ্টিকোন থেকে দুর্গাপুজো তাই প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার পুজো। ইন্দ্রিয় জয় করে, রিপু জয় করে মহামায়ার শক্তিকে নিজের মধ্যে অনুভব করার পুজো।
আগামী পর্বে আমরা আলোচনা করবো দুর্গাপুজোর ধর্মীয় তথা বৈদিক ও পৌরাণিক দিক নিয়ে। তার সাথে সাথে দেখবো ইতিহাস ও নৃতত্ববিজ্ঞান এই পুরো ধারণাটিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করে।
জনশ্রুতি অনুসারে, হুগলির গুপ্তিপাড়ায় স্থানীয় কিছু গ্রামবাসী এক জমিদার বাড়িতে দুর্গাপুজো দেখতে গিয়েছিলেন। কিন্তু জমিদারবাড়ির লোকেরা তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে এবং পুজোমণ্ডপে প্রবেশ করতে বাধা দেয় । এই ঘটনায় অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন যে, আর কখনও জমিদারবাড়ির পুজোয় যাবেন না, বরং নিজেরাই চাঁদা তুলে মায়ের আরাধনা করবেন। গ্রামের বারোজন যুবক এই উদ্যোগে […]
আশ্বিনে দুর্গাপুজোর উৎসবের রেশ নিয়েই কার্তিকের অমাবস্যায় বাঙালী মেতে ওঠে শ্যামা মায়ের আরাধনায়। দুর্গাপুজোর মতই গৃহস্থ পরিবার থেকে শুরু করে মন্দির ও বারোয়ারি সর্বত্রই কালী পুজোর বিস্তার। দুর্গার মতোই কালীও বাংলার নিজের ঘরের মা হয়ে উঠেছেন আমাদের মানসপুজোয়। কালী প্রকৃতিগত ভাবে উগ্র, ভয়ঙ্করী এবং শ্মশানচারিণী। এই ভয়ানক রূপকল্পনা থেকে মমতাময়ী ঘরের মা কালী হয়ে ওঠার যাত্রা হিন্দুশাস্ত্র ও ইতিহাসের এক আকর্ষনীয় যাত্রা। শুধু ধর্মীয় পরিধি নয়, এই পরিবর্তনের পিছনে লুকিয়ে আছে বাংলার জীবনশৈলী, দর্শন ও সমাজের এক আশ্চর্য বিবর্তনের গল্প।
সম্পূর্ণ প্রতিবেদনের পাঠ শুনুন 00:00 1X Sorry, no results.Please try another keyword ৩/ ধর্মীয় শক্তিপুজোর দৃষ্টিকোন – বৈদিক ও পৌরাণিক মিশ্রন আমাদের জ্ঞানচর্চার একটা বড়ো মুশকিল হলো তথ্যের প্রাচুর্য কিন্তু বোধের অভাব। দুর্গা নিয়েও আমাদের ইতিহাস চর্চার মূল উদ্দেশ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখি কোন পুরাণে কী গল্প লেখা আছে তাই আলোচনা। অবশ্য অন্যরকম হওয়ার কথাও নয়। […]


